
স্টাফ রিপোর্টারঃ
রাজধানীর মোহাম্মদপুরে মা ও কিশোরী মেয়েকে হত্যার ঘটনায় চারদিন আগে নিয়োগ পাওয়া গৃহকর্মীকে বরিশালের ঝালকাঠির নলছিটি এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ। ঢাকায় নিয়ে এসে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করা হয়েছে। তদন্ত দল মনে করছে, পরিকল্পিতভাবে হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়েছে এবং হত্যার পরে মূল্যবান সামগ্রী লুট করে অপরাধী পালানোর চেষ্টা করেছে।
ঘটনাটি ঘটেছে সোমবার, ৮ ডিসেম্বর ভোর থেকে সকাল সাড়ে নয়টার মধ্যে। মোহাম্মদপুরের শাহজাহান রোডের একটি বহুতল আবাসিক ভবনের সপ্তম তলায় পরিবারের একমাত্র বাসায় গৃহিণী লায়লা আফরোজ ও তার স্কুলপড়ুয়া মেয়ে নাফিসা নাওয়ালকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। পরিবারিক সূত্র মতে, লায়লা আফরোজ দীর্ঘদিন ধরে পরিবার নিয়ে সেখানে বসবাস করছিলেন এবং গৃহস্থালির কাজ সামলানোর জন্য অনেক দিন পর একজন নারী গৃহকর্মী নিয়োগ করেন।
তদন্তে জানা যায়, নিয়োগ পাওয়া নারী গৃহকর্মী কাজ শুরুর পর প্রতিদিন বোরকা পরে বাসায় প্রবেশ করতেন এবং মুখ ঢেকে থাকতেন। ফলে ভবনের সিসিটিভি ক্যামেরায় তার মুখ স্পষ্টভাবে ধরা পড়েনি। বাসায় লায়লা ও তার মেয়েই শুধু তার মুখ দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। নতুন ব্যক্তি হওয়ায় তার জাতীয় পরিচয়পত্র বা স্থায়ী ঠিকানাসহ কোনো ব্যক্তিগত তথ্য পরিবার সংগ্রহ করতে পারেনি।
ঘটনার দিন ভোর সাড়ে সাতটার দিকে লায়লার স্বামী, চাকরিজীবী আজিজুল ইসলাম কাজের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হন। সকাল ১১টার দিকে বাসায় ফিরে তিনি লায়লা আফরোজকে রান্নাঘরের পাশে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন। দেহে ধারালো অস্ত্রের একাধিক আঘাতের চিহ্ন ছিল। বাসার প্রধান দরজার কাছে মেয়েকে গুরুতর জখম অবস্থায় দেখতে পান তিনি। দ্রুত দুজনকেই হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক কিশোরী নাফিসাকে মৃত ঘোষণা করেন। লায়লা আফরোজের মৃত্যুর বিষয়টিও পরে নিশ্চিত করা হয়।
তদন্তকারীরা সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে দেখতে পান, সকাল ৭টা ৫১ মিনিটে গৃহকর্মী বাসায় প্রবেশ করেন এবং প্রায় দেড় ঘণ্টা পর ৯টা ৩৫ মিনিটে বাসা থেকে বের হয়ে যান। বের হওয়ার সময় বাসার মূল্যবান কিছু সামগ্রী, একটি মোবাইল ফোন, একটি ল্যাপটপ এবং কিছু স্বর্ণালংকার সহ নগদ অর্থ নিয়ে যান। সিসিটিভিতে দেখা যায়, বাসায় ঢোকার সময় তিনি বোরকা পরে ছিলেন, কিন্তু বের হওয়ার সময় তিনি নাফিসা নাওয়ালের স্কুল ড্রেস পরে বের হন।
তদন্ত দলের ধারণা, হত্যার পর নিজের চেহারা গোপন রাখতে এবং নজর এড়াতে স্কুল ড্রেস পরে বের হওয়া তার পূর্বপরিকল্পনার অংশ হতে পারে। এইভাবে পরিচয় পাল্টে বের হওয়ার কারণে নিরাপত্তাকর্মী ও প্রতিবেশীরা তাকে সহজে শনাক্ত করতে পারেনি।
ঘটনার পর আজিজুল ইসলাম মোহাম্মদপুর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় অজ্ঞাত পরিচয়ের নারী গৃহকর্মীকে একমাত্র আসামি করা হয়েছে। মামলার পর থেকেই পুলিশ প্রযুক্তিগত সহায়তা ব্যবহার করে সন্দেহভাজন ওই নারীর অবস্থান শনাক্তের চেষ্টা চালাচ্ছিল। ফুটেজ বিশ্লেষণ, মোবাইল ট্র্যাকিং ও বিভিন্ন সূত্র ধরে পুলিশ নলছিটি এলাকার একটি বাড়িতে তার অবস্থান নিশ্চিত করে অভিযান চালায়।
পুলিশ জানায়, গ্রেপ্তার অভিযানে স্থানীয় পুলিশের সহায়তায় ঢাকা থেকে বিশেষ টিম পাঠানো হয়। দুপুরের দিকে তাকে আটক করা হয় এবং পরবর্তী সময়ে ঢাকায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করা হয়েছে। তদন্ত দল হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য, পরিকল্পনা, সহযোগী আছে কি না, পরিচয় গোপন করে কীভাবে বাসায় প্রবেশ করল—এসব বিষয়ে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করছে।
এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে এলাকায় উদ্বেগ ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিবেশী ও স্থানীয় বাসিন্দারা মনে করছেন, পরিচয় যাচাই ছাড়া গৃহকর্মী রাখার ঘটনা বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করছে। অনেকেই বলছেন, শহরাঞ্চলে গৃহকর্মী নিয়োগের আগে আইডি যাচাই, এলাকা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ, থানায় তথ্য জমা রাখা ও নিরাপত্তা ক্যামেরা পর্যবেক্ষণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানায়, বাসা থেকে একটি ধারালো ছুরি উদ্ধার করা হয়েছে যা হত্যায় ব্যবহৃত হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া লুট হওয়া সামগ্রীর কিছু অংশ উদ্ধার হয়েছে কিনা, বা অন্য কারও কাছে স্থানান্তর করা হয়েছে কিনা— তা যাচাইয়ের প্রক্রিয়া চলছে।
এই ঘটনার পর আবারও আলোচনায় উঠে এসেছে গৃহকর্মী নিয়োগ পদ্ধতির নিরাপত্তাবোধ। অনেক ক্ষেত্রে কাজের জন্য ব্যক্তিগত তথ্য যাচাই করা হয় না, বিশ্বাসের ভিত্তিতে অচেনা মানুষকে ঘরে প্রবেশের সুযোগ দেওয়া হয়, যার ফলাফল ভয়াবহ হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নগর জীবনে নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জিজ্ঞাসাবাদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত হত্যাকাণ্ডের বিবরণ নিশ্চিত বলা যাচ্ছে না। তবে ঘটনা সংঘটিত হওয়ার সময়সূচি, হত্যাকাণ্ডের পদ্ধতি এবং হত্যার পর পালানোর ধরণ দেখে এটিকে একক পরিকল্পিত অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। অপরাধীর সঙ্গে অন্য কেউ সম্পৃক্ত ছিল কি না— তা নিশ্চিত হওয়ার অপেক্ষা।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানিয়েছে, পরিবারের নিরাপত্তা, প্রমাণ সংগ্রহ, তদন্তের স্বচ্ছতা এবং প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণ—সবদিক বিবেচনা করে দ্রুত মামলার অগ্রগতি নিশ্চিত করা হবে।