১৪ ডিসেম্বর: শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে বাংলাদেশ ভূমিহীন আন্দোলনের ঐতিহাসিক বক্তব্য

সেলিম মাহবুবঃ

১৪ ডিসেম্বর—বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গভীর শোক, বেদনা ও আত্মপর্যালোচনার দিন। মহান মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের প্রাক্কালে এদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দেশীয় দোসররা। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ ভূমিহীন আন্দোলনের পক্ষ থেকে জাতির এই বেদনাবিধুর অধ্যায় স্মরণ করে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি প্রদান করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ভূমিহীন আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক শেখ নাসির উদ্দিন এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছামিউল আলম যৌথভাবে প্রদত্ত বিবৃতিতে বলেন, ১৪ ডিসেম্বর বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক নির্মম ও কলঙ্কিত অধ্যায়। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে যখন পাকিস্তানি বাহিনী তাদের অনিবার্য পরাজয় উপলব্ধি করে, তখন তারা সুপরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের মেধা ও নেতৃত্বকে ধ্বংস করার ঘৃণ্য সিদ্ধান্ত নেয়।

বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগী রাজাকার, আল-বদর ও আল-শামস বাহিনী দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, গবেষক, কবি, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিকর্মীদের ধরে নিয়ে গিয়ে অমানবিক নির্যাতনের পর হত্যা করে। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীন বাংলাদেশকে নেতৃত্বশূন্য ও মেধাশূন্য করে ফেলা, যাতে নতুন রাষ্ট্রটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে।

বাংলাদেশ ভূমিহীন আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বলেন, নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, অসংখ্য শহীদের আত্মদান এবং অগণিত নির্যাতনের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীনতা কেবল সশস্ত্র যুদ্ধের ফসল নয়। এই সংগ্রামের প্রতিটি ধাপে এদেশের বুদ্ধিজীবীদের চিন্তা, নেতৃত্ব ও সাহসিক ভূমিকা ছিল অপরিসীম। মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক কাঠামো নির্মাণ, মুজিবনগর সরকার গঠন, সেক্টরভিত্তিক যুদ্ধ পরিচালনা, আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায় এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশাসনিক রূপরেখা তৈরিতে বুদ্ধিজীবীরা অনন্য ভূমিকা পালন করেন।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বর গণহত্যার পর দেশের সাধারণ মানুষের পাশাপাশি বুদ্ধিজীবীরাও প্রতিরোধে প্রস্তুত হন। কলম, কণ্ঠ ও চিন্তার শক্তিকে অস্ত্র বানিয়ে তারা বাঙালি জাতিকে মুক্তির সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেন। পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে আপসহীন অবস্থান গ্রহণ করায় তারা পরিণত হন ঘৃণ্য প্রতিশোধের লক্ষ্যবস্তুতে।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে যখন একের পর এক পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্প ধ্বংস হতে থাকে এবং শত্রুবাহিনী আত্মসমর্পণের পথে অগ্রসর হয়, তখনই চূড়ান্ত বিজয়ের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। এই হত্যাযজ্ঞ ছিল সম্পূর্ণ পরিকল্পিত এবং রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট।

পরবর্তীতে ঢাকার মিরপুর, রায়েরবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে গণকবর আবিষ্কৃত হয়। সেখানে পাওয়া যায় চোখ বাঁধা, হাত-পা বাঁধা, গুলিবিদ্ধ ও ধারালো অস্ত্রে জখম করা অসংখ্য মরদেহ। এসব আলামত থেকে স্পষ্ট হয়, হত্যার আগে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের উপর ভয়াবহ নির্যাতন চালানো হয়েছিল।

বিবৃতিতে ইতিহাসভিত্তিক তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, ১৯৭২ সালে প্রকাশিত জাতীয় সংকলন, পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ এবং আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা এক হাজারেরও বেশি। বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ’-এ ২৩২ জনের নাম অন্তর্ভুক্ত হলেও তালিকাটি অসম্পূর্ণ বলে স্বীকার করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ভূমিহীন আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বলেন, স্বাধীনতার পর বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের বিচার ও প্রকৃত সংখ্যা নির্ধারণে একাধিক তদন্ত উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও সেগুলোর অনেকগুলোই আলোর মুখ দেখেনি। বুদ্ধিজীবী নিধন তদন্ত কমিটির প্রধান জহির রায়হানের রহস্যজনক নিখোঁজ হওয়া আজও জাতির জন্য এক বেদনাদায়ক প্রশ্নচিহ্ন।

বিবৃতিতে বলা হয়, শহীদ বুদ্ধিজীবীরা কেবল অতীতের ইতিহাস নন—তারা বর্তমান ও ভবিষ্যতের পথপ্রদর্শক। অন্যায়, শোষণ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তাদের আপসহীন অবস্থান আজও আমাদের আন্দোলন ও সংগ্রামের অনুপ্রেরণা। ভূমিহীন মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়েও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আদর্শ আমাদের শক্তি জোগায়।

বাংলাদেশ ভূমিহীন আন্দোলন মনে করে, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রকৃত সম্মান জানাতে হলে কেবল আনুষ্ঠানিক স্মরণ নয়, বরং তাদের স্বপ্নের একটি বৈষম্যহীন, ন্যায়ভিত্তিক ও মানবিক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে। যেখানে ভূমিহীন, শ্রমজীবী ও প্রান্তিক মানুষের অধিকার নিশ্চিত হবে।

বিবৃতির শেষাংশে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করা হয় এবং তাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে গণতান্ত্রিক ও সামাজিক ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের আহ্বান জানানো হয়।

১৪ ডিসেম্বর: শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে বাংলাদেশ ভূমিহীন আন্দোলনের ঐতিহাসিক বক্তব্য

ডিসেম্বর ১৪, ২০২৫

সেলিম মাহবুবঃ

১৪ ডিসেম্বর—বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গভীর শোক, বেদনা ও আত্মপর্যালোচনার দিন। মহান মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের প্রাক্কালে এদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দেশীয় দোসররা। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ ভূমিহীন আন্দোলনের পক্ষ থেকে জাতির এই বেদনাবিধুর অধ্যায় স্মরণ করে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি প্রদান করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ভূমিহীন আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক শেখ নাসির উদ্দিন এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছামিউল আলম যৌথভাবে প্রদত্ত বিবৃতিতে বলেন, ১৪ ডিসেম্বর বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক নির্মম ও কলঙ্কিত অধ্যায়। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে যখন পাকিস্তানি বাহিনী তাদের অনিবার্য পরাজয় উপলব্ধি করে, তখন তারা সুপরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের মেধা ও নেতৃত্বকে ধ্বংস করার ঘৃণ্য সিদ্ধান্ত নেয়।

বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগী রাজাকার, আল-বদর ও আল-শামস বাহিনী দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, গবেষক, কবি, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিকর্মীদের ধরে নিয়ে গিয়ে অমানবিক নির্যাতনের পর হত্যা করে। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীন বাংলাদেশকে নেতৃত্বশূন্য ও মেধাশূন্য করে ফেলা, যাতে নতুন রাষ্ট্রটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে।

বাংলাদেশ ভূমিহীন আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বলেন, নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, অসংখ্য শহীদের আত্মদান এবং অগণিত নির্যাতনের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীনতা কেবল সশস্ত্র যুদ্ধের ফসল নয়। এই সংগ্রামের প্রতিটি ধাপে এদেশের বুদ্ধিজীবীদের চিন্তা, নেতৃত্ব ও সাহসিক ভূমিকা ছিল অপরিসীম। মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক কাঠামো নির্মাণ, মুজিবনগর সরকার গঠন, সেক্টরভিত্তিক যুদ্ধ পরিচালনা, আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায় এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশাসনিক রূপরেখা তৈরিতে বুদ্ধিজীবীরা অনন্য ভূমিকা পালন করেন।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বর গণহত্যার পর দেশের সাধারণ মানুষের পাশাপাশি বুদ্ধিজীবীরাও প্রতিরোধে প্রস্তুত হন। কলম, কণ্ঠ ও চিন্তার শক্তিকে অস্ত্র বানিয়ে তারা বাঙালি জাতিকে মুক্তির সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেন। পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে আপসহীন অবস্থান গ্রহণ করায় তারা পরিণত হন ঘৃণ্য প্রতিশোধের লক্ষ্যবস্তুতে।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে যখন একের পর এক পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্প ধ্বংস হতে থাকে এবং শত্রুবাহিনী আত্মসমর্পণের পথে অগ্রসর হয়, তখনই চূড়ান্ত বিজয়ের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। এই হত্যাযজ্ঞ ছিল সম্পূর্ণ পরিকল্পিত এবং রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট।

পরবর্তীতে ঢাকার মিরপুর, রায়েরবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে গণকবর আবিষ্কৃত হয়। সেখানে পাওয়া যায় চোখ বাঁধা, হাত-পা বাঁধা, গুলিবিদ্ধ ও ধারালো অস্ত্রে জখম করা অসংখ্য মরদেহ। এসব আলামত থেকে স্পষ্ট হয়, হত্যার আগে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের উপর ভয়াবহ নির্যাতন চালানো হয়েছিল।

বিবৃতিতে ইতিহাসভিত্তিক তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, ১৯৭২ সালে প্রকাশিত জাতীয় সংকলন, পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ এবং আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা এক হাজারেরও বেশি। বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ’-এ ২৩২ জনের নাম অন্তর্ভুক্ত হলেও তালিকাটি অসম্পূর্ণ বলে স্বীকার করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ভূমিহীন আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বলেন, স্বাধীনতার পর বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের বিচার ও প্রকৃত সংখ্যা নির্ধারণে একাধিক তদন্ত উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও সেগুলোর অনেকগুলোই আলোর মুখ দেখেনি। বুদ্ধিজীবী নিধন তদন্ত কমিটির প্রধান জহির রায়হানের রহস্যজনক নিখোঁজ হওয়া আজও জাতির জন্য এক বেদনাদায়ক প্রশ্নচিহ্ন।

বিবৃতিতে বলা হয়, শহীদ বুদ্ধিজীবীরা কেবল অতীতের ইতিহাস নন—তারা বর্তমান ও ভবিষ্যতের পথপ্রদর্শক। অন্যায়, শোষণ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তাদের আপসহীন অবস্থান আজও আমাদের আন্দোলন ও সংগ্রামের অনুপ্রেরণা। ভূমিহীন মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়েও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আদর্শ আমাদের শক্তি জোগায়।

বাংলাদেশ ভূমিহীন আন্দোলন মনে করে, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রকৃত সম্মান জানাতে হলে কেবল আনুষ্ঠানিক স্মরণ নয়, বরং তাদের স্বপ্নের একটি বৈষম্যহীন, ন্যায়ভিত্তিক ও মানবিক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে। যেখানে ভূমিহীন, শ্রমজীবী ও প্রান্তিক মানুষের অধিকার নিশ্চিত হবে।

বিবৃতির শেষাংশে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করা হয় এবং তাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে গণতান্ত্রিক ও সামাজিক ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের আহ্বান জানানো হয়।